বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া
রাজীব পাল রনী:
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১
হঠাৎ করেই কোথাও থেকে ঘুরে আসতে মন চাইছিল। প্রথমে ঠিক করতে পারছিলাম না কোথায় যাব। পরে বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে ঘুরে আসব। যোগেশ দাদা বললেন, তিনি আগে একবার গিয়েছিলেন, বেড়ানোর জন্য জায়গাটা মন্দ নয়। শিবু ভাই ৬ হাজার টাকায় ১১ সিটের একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করলেন। ঢাকা থেকে কাকডাকা ভোরে রূপন, শিবু, রিপন, পলাশ, আশিক, শামিম, যোগেশদা, আমিসহ ৮ জন্যের একটি দল রওনা হলাম টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে। গল্প করতে করতে চলে এলাম মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ফেরিঘাটে। ফেরিতেই সকালের নাশতা সারা হলো। পদ্মা নদীর মাঝে জেগে ওঠা চর দেখতে দেখতে ফেরি পার হয়ে আবার চলা শুরু। পিচঢালা রাস্তার দুই পাশে মনোরম সারি সারি গাছ আর শাপল বিল দেখতে দেখতে গোপালগঞ্জ সদর পেরিয়ে টুঙ্গিপাড়া পৌঁছলাম, তখন প্রায় বেলা ১১টা। মাইক্রোবাস থেকে নেমে প্রথমেই দেখতে পেলাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধের প্রধান ফটক। বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সের ফটক পেরিয়ে সামনের দুই পাশের উদ্যানে প্রবেশ করতেই চোখ পড়ল পাথরের গায়ে লেখা ‘দাঁড়াও পথিক বর যথার্থ বাঙালি যদি তুমি হও। ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও, এই সমাধিস্থলে। এখানে ঘুমিয়ে আছে, বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা’। আমরা এক এক করে সমাধিবেদির পাশে দাঁড়িয়ে কিছু সময় প্রার্থনা করলাম। এই টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে একদল বিপথগামী সামরিক বাহিনীর হাতে সহপরিবারে বঙ্গবন্ধু নৃশংসভাবে নিহত হন। এই শোকাবহ ঘটনা জাতির লজ্জা, দুর্ভাগ্যের। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডির সেই বাড়িটি এখন জাদুঘর। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, বীরত্ব, সংগ্রাম ও ত্যাগের চিহ্ন বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে এই জাদুঘর।
টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বঙ্গবন্ধুর মা-বাবার পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানের ৩৮ দশমিক ৩০ একর জমির ওপর প্রত্নবিভাগ এই সমাধি সৌধ নির্মাণ করা হয়। প্রাচীন গ্রিক স্থাপত্য রীতির সঙ্গে আধুনিক স্থাপত্যকলার চমৎকার সংমিশ্রণে তৈরি বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স। এই সমাধি সৌধটি নকশা করেন স্থপতি ইকবাল এহসান, ইকবাল হাব্বি আর ইশতিয়াক কবির। চারদিকে কালো টাইলস আর মাঝখানে শ্বেতশুভ্র টাইলসে বাঁধানো বঙ্গবন্ধুর সমাধি। সৌধের ওপর দেয়ালের জাফরিকাটা দিয়ে সূর্যের আলোয় আলোকিত হয় বঙ্গবন্ধুর সমাধি। ২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাধি সৌধের উদ্বোধন করেন।
সমাধিক্ষেত্র ঘুরে আমরা চলে আসি বঙ্গবন্ধু যে ঘরে জন্মেছিলেন সেখানে। সেই ঘরটা এখন আর নেই। ১৯৭১ সালে সেই বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। পরে দেশ স্বাধীন হলে সেখানে নির্মিত হয় তিনতলা ভবন। সেই ভবনের নিচতলায় যাই। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, ফ্রেমে বাঁধা তাঁদের ছবি ও বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতার ব্যবহৃত মূল্যবান জিনিসপত্র শোকেসে সাজানো রয়েছে। তা দেখে কয়েক কদম হেঁটে চলে এলাম লাইব্রেরি কাম মিউজিয়ামে। প্রবেশ করতেই দেখতে পেলাম ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে করাচি নিয়ে যাওয়ার আলোকচিত্র, বঙ্গবন্ধুর ৭ র্মাচের ভাষণের আলোকচিত্র, রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শপথ অনুষ্ঠানের আলোকচিত্র, আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোকচিত্র এবং তাঁর পরিবারসহ স্বাধীনতা আন্দোলনের দুলর্ভ সব আলোকচিত্র, বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত পোশাক ও জিনিসপত্র, জীবনের শেষ সঙ্গী কাঠের কফিন, বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা ‘ আমার কিছু কথা’, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার লেখা ‘আমার পিতা শেখ মুজিব’, ‘ওরা টোকাই কেন’ প্রভৃতি বইসহ এই লাইব্রেরি কাম মিউজিয়ামে ২ হাজারের বেশি বই রয়েছে, তা আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম ।এসব দেখে সবাই মুগ্ধ হলাম। মিউজিয়ামের পাশেই গ্রিক ঢঙে তৈরি উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চ দেখে দুই পাশের ফুলের বাগানের নানা জাতের ফার্ন, অর্কিড, ফলদ ও বনজ সারি সারি গাছের ছায়ায় কিছু সময় আমরা প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে গেলাম। তখন সূর্য মাথার ওপর। পেটে টান পড়েছে তাই সঙ্গে থাকা খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ঘাট বাঁধানো পুকুরপাড়ে। এই পুকুরে গোসল করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পুকুরপাড়ে বসে গল্প করতে করতে সূর্য ঢলে পড়েছে। অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই টুঙ্গিপাড়া থেকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম ঢাকার পথে। বঙ্গবন্ধুর শৈশব, বাল্য, কৈশোর ও রাজনীতির হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে। শেখ মুজিব বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তিনি নিজের জীবন দেশবাসীর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য জাতি তাঁর কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবে। তাই অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার ভাষায় বলতে হয়- ‘যত দিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, তত দিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’।
কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে ২৪০ কিলোমিটার দূরত্ব গোপালগঞ্জ জেলা। ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ, ফুলবাড়িয়া থেকে টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস, পান্না ডিলাক্স, গ্রিন লাইন পরিবহন, কমফোর্ট পরিবহন, আমিন পরিবহন, সেবা ইত্যাদি পরিবহনের বাস চলাচল করে গোপালগঞ্জ। ভাড়া ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। গোপালগঞ্জ শহরের বেদগ্রাম অথবা পুলিশ লাইনস মোড় থেকে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে লোকাল বাস ছেড়ে যায় ৩০ মিনিট পরপর। ভাড়া ৪০ টাকা। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ সদর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা রিজার্ভ করে যেতে পারেন টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি দেখতে। ভাড়া ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা।
কোথায় থাকবেন: গোপালগঞ্জ জেলা সদরে থাকার জন্য কয়েকটি সাধারণ মানের আবাসিক হোটেল আছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌরঙ্গীতে হোটেল পলাশ, লঞ্চঘাট মোড়ে হোটেল তাজ, পোস্ট অফিস মোড়ে হোটেল সোহাগ, চৌরঙ্গীর প্রধান সড়কের সামনে হোটেল রিফাত ও হোটেল শিমুল রয়েছে। এসব হোটেলে ধরন অনুযায়ী রুম ভাড়া ৪০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। এ ছাড়া টুঙ্গিপাড়া থানা রোডে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মধুমতি নামে একটি মোটেল আছে। মোটেলটিতে এসি ও নন-এসি রুম রয়েছে। ভাড়া ৮০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া এখানে ডরমিটরিতে ৫২টি সিট রয়েছে। ভাড়া ২০০ টাকা। মোটেলটিতে খাবারের ব্যবস্থাও আছে। এখানে মধুমতী নদীর মাছসহ দেশীয় সব খাবারের স্বাদ নিতে পারেন।
ছবি: লেখক